
ছবি : কবি আবদুল হাই মাশরেকী
ডেস্ক নিউজ: লোকজীবনের অভীপ্সার রূপকার, মাটি ও মানুষের কবি আবদুল হাই মাশরেকীর ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ (৪ ডিসেম্বর ২০১৯, বুধবার)। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচির মধ্যে কবি আবদুল হাই মাশরেকী পরিষদ এদিন সকাল ৯টায় ময়মনসিংহ ঈশ্বরগঞ্জে কবির মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ ও জিয়ারতের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এছাড়াও সকাল ১০টায় ঈশ্বরগঞ্জের দত্তপাড়া গ্রামে কবির বাড়িতে এক আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলও আয়োজন করেছে পরিষদ।
১৯০৯ সালে মন্তান্তরে ১৯১৯ সালের ১ এপ্রিল ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ থানার দত্তপাড়া গ্রামে মাতুলালয়ে কবি আব্দুল হাই মাশরেকী জন্ম গ্রহণ করেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতোই প্রতিবাদী এ লোককবির মৃত্যুর প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও অপ্রকাশিত রয়ে গেছে তার অনেক লেখনি। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি দেশের এ বিশিষ্ট গীতিকার, সাহিত্যিক, কবি, গবেষক ও সাংবাদিকের। মাটি ও মানুষের এ লোককবি আব্দুল হাই মাশরেকী ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন একজন সাংবাদিক।
‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দেরে তুই’- যুগ যুগ ধরে জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থানে থাকা এ পল্লীগীতির লেখক কবি আব্দুল হাই মাশরেকী। শুধু গান নয়, গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় পালাগান-রাখাল বন্ধু, জরিনা সুন্দরী, মাঠের গান, ঝিঙে ফুলের লতা, দুখু মিয়ার জারি, হযরত আবু বকর (রা.) পুঁথি সাহিত্যেরও লেখক ছিলেন এ কবি।
চল্লিশের দশকের মধ্যভাগ থেকে সত্তরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত মাশরেকীর লেখালেখি উভয় বাংলা তথা কলকাতা ও ঢাকার পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়। তার লেখা কবিতা,গান, ছোটগল্প নানা কাগজে প্রকাশিত হয়।দ’টি নাটক ও কিছু অনুবাদকর্মও তিনি করেছেন। বেশকিছু গীতিনাট্যেরও রচয়িতা তিনি। সে সময়ের মোহাম্মদী, পরিচয়, দিলরুবা, সাওগাত, মাহে-নও, পূবালী, কৃষিকথা, এলানসহ বিভিন্ন সাময়িকীতে তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
তার উল্লেখযোগ্য কবিতার মধ্যে-‘ এই বীভৎস হানাহানি আর/ এই মৃত্যুকে স্বীকার করিনি কভু/ মানুষেরপথ’,‘শ্বাপদ হিংস্র নখরে বিঁধিছে তবু/ তবু তো রক্তে ভিজে গেল রাজপথ’, হে আমার দেশ হৃদয়ের প্রেম দিয়ে তোমাকে তো ভালবাসি হে আমার দেশ’, এই তো পেয়েছি মাকে/ বাড়ির সামনে তার নতুন কবর/ বধ্যভূমি ঘুরে ঘুরে।
বাংলা গানের বিশিষ্ট গীতিকার হিসেবে মাশরেকীর নাম স্মরণযোগ্য। যৌবনের প্রারম্ভে তিনি কলকাতার এইচএমভির সঙ্গে পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। ১৯৬৮ সালে ঢাকার গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গেও গীতিকার হিসেবে তিন বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। ঢাকা বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার তিনি। তার অসংখ্য গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় পল্লীগীতি গানের একটি ‘প্রাণ সখীরে, বাবলা বনের ধারে ধারে বাঁশি বাজায় কে-’ । তার লেখা ‘ওরে আমার ঝিলাম নদীর পানি’ গানটি তৎকালীন রেডিও সংবাদের আগে ও পরে বাজানো হতো।
শহীদদের স্মরণে তার লেখা- ‘তারা মরে নাই তারা যে অমর/ নহে গো নহে এ তাদের কবর’। গ্রামীণ লোকসাহিত্যের পাশাপাশি তিনি মানুষকে গণতন্ত্রের প্রতি আগ্রহী করতে লিখেছেন- ‘এসো গণতন্ত্র গড়ে তুলি/ নতুন দিনের/ এসো করব কায়েম রাজ-কলুষ হীনেরসহ অসংখ্য গান। দেশাত্মবোধক গানের উল্লেখযোগ্য ‘বাংলা মা তোর শ্যামল বরণ/ হৃদয় আমার করল হরণ’। ইসলামী গানের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়, ‘পড়ি তাসমিয়া পড়ি বিসমিল্লাহ/পড়ি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।
তিনি কলকাতায় থাকাকালীন এবং ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপিগুলো এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের দেয়া উপহার ‘হারমোনিয়াম’ সেখানে রেখে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে চলে আসেন।
১৯১৯ সালের ১ এপ্রিল ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ থানার দত্তপাড়া গামে কবি আব্দুল হাই মাশরেকী জন্ম (শিক্ষা সনদ অনুযায়ী)গ্রহণ করেন। বাবা ওসমান গনি সরকার আর মা রহিমা খাতুন। বাবা ছিলেন জমিদার বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী।
কবি আব্দুল হাই মাশরেকী পিত্রালয় থেকে প্রাথমিক পাঠ শেষে ঈশ্বরগঞ্জের চরনিখলা মধ্য ইংরেজি স্কুলে পরে কাঁকনহাটি গামে মাতুলালয়ে থেকে জাটিয়া হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন ১৯৩৯ সালে। অতপর ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অকালে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনে ছেদ পড়ে। কর্মজীবনের শুরুতে শিক্ষকতা ও পরে জুট রেগুলেশনে চাকরি করেন। তিনি দৈনিক সংবাদে সহ-সম্পাদক এবং পরবর্তী সময়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষিকথা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৭৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তার ‘চোর’ গল্প প্রকাশিত হয়। আমাদের সাহিত্যাকাশের নিত্য স্মরণীয় কোন জ্যোতিষ তিনি হতে পারেননি সত্য, তবে অনেক তারকার মধ্যে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল। লিখেও ছিলেন তিনি কম নয়, কিন্তু প্রকাশিত হয়েছে ক’খানা। জীবদ্দশায় প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো- ‘দুখু মিয়ার জারি’(পল্লিগীতিকা ১৯৬১), ‘কুলসুম’(ছোটগল্প ১৯৯১), ‘বাউল মনের নকশা’(‘কুলসুম’ এর নামন্তরিত বর্ধিত সংস্করণ ১৯৫৪), ‘সাকো’ (একাঙ্কিকা ১৯৫৯), ‘আকাশ কেন নীল’(অনুবাদ শিশুতোষ বিজ্ঞান ১৯৬২), ‘মাঠের কবিতা মাঠের গান’(কবিতা ১৯৭০), ‘নতুন গাঁয়ের কাহিনী’( নাটক ১৯৭০)। ১৯৮৮ সালের ৪ ডিসেম্বর কবি আব্দুল হাই মাশরেকী সকলকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
মৃত্যুর পর ছেলেদের সহযোগিতায় বেশ কিছু পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হলেও অনেক পাণ্ডুলিপি রয়েছে এখনো প্রকাশের বাইরে। এ লোককবির অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি গুলো প্রকাশিত হলে তার প্রকৃত শিল্পীসত্তা ও শক্তিমত্তার প্রকৃত স্থান নির্ধারণ সম্ভব বলে সাহিত্যপ্রেমীরা মত পোষণ করেন।
কবি আবদুল হাই মাশরেকী আধুনিক কবিতাসহ জারী, পালাগান, পুঁথি, নাটক, গীতিনাট্য, গান, গল্প, প্রবন্ধ ও অনুবাদ অনবদ্য সৃষ্টির স্রষ্টা।
কবি আবদুল হাই মাশরেকীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- কিছু রেখে যেতে চাই (আধুনিক কবিতা), হে আমার দেশ (আধুনিক কবিতা), ভাটিয়ালী (আধুনিক কবিতা), মাঠের কাব্য মাঠের গান (কবিতা), ডাল ধরে নোয়াইয়া পড়ে কন্যা (সঙ্গীত), কুলসুল (গল্প), বাউল মনের নকশা (গল্প), নদী ভাঙে (গল্প), মানুষ ও লাশ (গল্প), সাঁকো (নাটক), নতুন গায়ের কাহিনী (নাটক), রাখালবন্ধু (পালাগান), জরিনা সুন্দরী (পালাগান), দুখু মিয়ার জারী (জারীকাব্য), বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার জারী (জারীকাব্য), আবু বকর (রা.) জীবনী (পুঁথি), আকাশ কেন নীল (অনুবাদ) ইত্যাদি।
তার উল্লেখযোগ্য গানসমূহ- তারা মরে নাই তারা যে অমর, বাংলা মা তোর শ্যামল বরণ, একদিন হবে ভুলিতে, আল্লাহ মেঘ দে পানি দে, নদীর ঘাটে কলশি তার ভাসে না, বহু দিনের পিরিতি বন্ধু, কাঙ্খে কলশি গিয়াছে ভাসি, আরে ও দুখু মিয়া ভাই এই দুনিয়ায় দুঃখের সীমা নাই ইত্যাদি।